তুরস্কের ভ্রমণ
POSTED BY :
একদিকে সমৃদ্ধ ইতিহাসে পরিপূর্ণ অন্যদিকে সমুদ্র সৈকত ও পাহাড়ের সৌন্দর্যে স্নাত – তুরস্ক। হাজার হাজার বছর ধরে ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যকার প্রবেশপথ হিসেবে পরিচিত এই তুরস্ক। বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কেন্দ্রবিন্দু হওয়াতে তুরস্ক হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময় একটি দেশ। ইউরোপ ও এশিয়ার মিলনস্থল হওয়াতে দুই মহাদেশের সংস্কৃতির প্রভাব সমান ভাবে লক্ষ্য করা যায় তুরস্কের সংস্কৃতিতে। যার ফলশ্রুতিতে তুরস্কের রন্ধন শৈলী, ধর্মীয় স্থাপনা, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান গুলোর মধ্যে রয়েছে চোখে পড়ার মত বৈচিত্র্য। অতীতের বাইজেন্টাইন এবং অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী হওয়ায় ইস্তাম্বুল সবসময়ই পর্যটকদের তালিকায় জায়গা করে নেয়। তবে তুরস্ক দেখার জায়গা রয়েছে অনেক। তাই হাতে সময়ে নিয়ে ভ্রমণ করতে আসলে বেশ কয়েকটি জায়গা দেখা যাবে।
আপনার হাতে যদি ৩ থেকে ৪ দিনের মতন সময় থাকে তাহলে নিচের জায়গা গুলো ঘুরে আসতে পারেন এবং উপভোগ করতে পারেন রূপবৈচিত্র।
ইস্তাম্বুল
একসময় অটোমান এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এই ইস্তাম্বুল। পৃথিবীর বৃহত্তর শহর গুলোর মধ্যে অন্যতম ইস্তাম্বুল তুরস্কের সবচেয়ে বড় শহর। সংকীর্ণ প্রণালির মধ্যে অবস্থিত ইস্তাম্বুল শহরটাই পৃথিবীর একমাত্র শহর যেটি এশিয়া ও ইউরোপের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করছে। চিত্তাকর্ষক স্থাপত্য, ঐতিহাসিক সাইট, খাবার, শপিং, রাতের আয়োজন ও চমৎকার আবহাওয়ার কারণে ইস্তাম্বুলকে তুরস্কের সর্বোৎকৃষ্ট বেড়ানোর স্থান বলা যায়। পুরনো শহরেই আপনি খুঁজে পাবেন সব দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থান গুলো। যার মধ্যে রয়েছে হাইয়া সোফিয়া, নীল মসজিদ ও টপকাপি প্যালেস।
ক্যাপাডোসিয়া
কেন্দ্রীয় আনাতোলিয়ায় অবস্থিত ক্যাপাডোসিয়া সুপরিচিত হয়েছে এর অস্বাভাবিক আকৃতির পাহাড়ের সমন্বয়ে গঠিত রূপকথার রাজ্যের মত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য। প্রাচীন আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত বেয়ে পড়া ও প্রাকৃতিক ভূমি ক্ষয় থেকে কালে কালে এই অঞ্চলের পাহাড় গুলো এমন উদ্ভট আকৃতি ধারণ করেছে। এর পরে হাজার বছর আগে মানুষ এই পাহাড় গুলোর বুকে খুড়ে খুড়ে বসত বাড়ি, মন্দির ও ভূগর্ভস্থ শহর তৈরি করে। হিটাইটস-রা সর্বপ্রথম পারস্য ও গ্রীক আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ ধাঁধা খনন করে। এর অনেক পরে খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীরা ক্যাপাডোসিয়ার এসব সুড়ঙ্গপথ ও গুহায় আশ্রয় নেয়। বর্তমানে এসব গুহার মধ্যেই নির্মিত হয়েছে হোটেল ও রেস্তোরাঁ।
এফেসাস
এফেসাস শহরটাও তুরস্কের এজিয়ান অঞ্চলেই অবস্থিত। সম্ভবত এটি ইউরোপের সবচেয়ে পরিপূর্ণ ক্লাসিক্যাল মহানগরী। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যের বৃহত্তর শহর গুলোর একটি ছিল এফেসাস। প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি, আর্টেমিসের মন্দির এখানেই অবিস্থিত ছিল। এফেসাসের ধ্বংসাবশেষ একটি বিশাল প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট হিসেবে খুব ভাল ভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ কারণেই এফেসাস তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ। আকর্ষণ গুলোর মধ্যে রয়েছে প্রকাণ্ড থিয়েটার, হাদ্রিয়ান মন্দির, দ্বিতল বিশিষ্ট বিশাল সেলসাস গ্রন্থাগার।
তাছাড়াও এগুলো সহ আরো বেশ কিছু জায়গা রয়েছে যেগুলো ভ্রমণের জন্য আপনাকে ৬ থেকে ৭ দিনের হাতে সময় নিয়ে আসতে হবে।
বোড্রম
প্রাচীন বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি হচ্ছে মোসোলেয়াম। যা অবস্থিত ছিল তুরস্কের দক্ষিণ এজিয়ান অঞ্চল এই বোড্রম-এ। বর্তমানে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, সমুদ্র সৈকত ও পাহাড়ের চুড়ায় রেস্তোরাঁর জন্য বোড্রম বিখ্যাত। সেন্ট পিটারের দুর্গ না দেখলে আপনার বোড্রম ভ্রমণই বৃথা যাবে। যা বোড্রম ক্যাসেল নামেও পরিচিত। ১৪০২ খ্রিস্টাব্দে নাইট হসপিটালার এটি নির্মাণ করেন। যা বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বোড্রমের পূর্ব দিকে রয়েছে তুরস্কের বিখ্যাত নীল পানির সমুদ্র সৈকত। সৈকতের কাছেই পাবেন ক্যাফে, বার ও নাইটক্লাব। আর পশ্চিম দিকে পাবেন মারিনা, শপিং সেন্টার এবং রেস্টুরেন্ট।
সাইড
প্রাচীন পামফিলিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর যা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর অধীনে ছিল। সাইড বর্তমানে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও আধুনিক রিসর্ট সম্বলিত একটি দৃষ্টিনন্দন শহর। ছোট একটি উপদ্বীপে অবস্থিত সাইডে আপনি পাবেন অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতি, খাবার আয়োজন ও রাতের জাঁকজমক। এই শহরের মূল আকর্ষণ হল মাটি খুড়ে আবিষ্কৃত প্রাচীন হেলেনীয় এবং রোমান প্রকাণ্ড অ্যামপিথিয়েটার ও বিভিন্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। সরু রাস্তা এবং আকর্ষণীয় বাগানে সাজানো শহর সাইড জুড়েই আপনি পাবেন নামকরা পিজার দোকান ও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের খাবারের জন্য বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ।
মারমারিস
তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্ট গুলোর একটি মারমারিস। পাইন গাছে ঢাকা পাহাড়, সাদা বালির সৈকত, ফিরোজা নীল রঙের সমুদ্র এবং ঐতিহাসিক স্থাপত্য সব মিলিয়ে হয়তো সবচেয়ে সুন্দর রিসোর্ট এটি। দক্ষিণ পশ্চিম তুরস্কের টার্কিশ রিভিয়েরার সাথেই এর অবস্থান। ওয়াটার স্পোর্টস, রোমাঞ্চকর কারসাজি, চমৎকার খাবারের আয়োজন ও জাঁকজমকপূর্ণ রাতের পরিবেশের জন্য পর্যটকেদের কাছে মারমারিসের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। এখানে আপনি পাবেন নৌকা ভ্রমণের আয়োজন। যাতে করে ঘুরে দেখতে পারবেন অসম্ভব সুন্দর এই উপসাগরীয় অঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চল। এতেও যদি আপনার মন না ভরে তবে দিনে দিনেই আপনি ঘুরে আসতে পারবেন ডালিয়ান, ইফেসাস, পামুকেলে ও ক্লিওপেট্রা দ্বীপ।
এই জায়গা গুলো মূল আকর্ষণ তবে যদি আরো কিছু সুন্দর জায়গা ভ্রমণে মনস্থির করতে পারনে তাহলে হাতে ৮ থেকে ৯ দিনের সময় নিয়ে আসবেন যাতে করে আরো কিছু জায়গা ঘুরে আসতে পারেন।
আন্টালিয়া
অসংখ্য রিসোর্ট, হোটেল, বার এবং রেস্টুরেন্টে সাজানো বিশাল এক শহর আন্টালিয়া। ভূমধ্য সাগরের উপকূলে এই শহরের অবস্থান। শহরটির একদিকের সীমানা জুড়েই দর্শনীয় সমুদ্র সৈকত আর সবুজ পাহাড়। এর ভেতরে ভেতরে প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ। সাঁতার কাটা, নৌকা চালানো, পর্বত আরোহন এসব কিছুই পাবেন আন্টালিয়াতে। দেখার মত স্থাপনার তালিকায় আছে কালেইচি, ওল্ড কোয়ার্টার, পুরানো শহরের দেয়াল, রোমান গেট, ধাঁধাময় প্রাচীন রাস্তা ও ক্লক টাওয়ার।
কনিয়া
বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে কনিয়া একটি। অসাধারণ সেলজুক স্থাপত্য ও ঘূর্ণায়মান সুফি দরবেশদের জন্য এই শহর সুপরিচিত। তুরস্কের মধ্য আনাতোলিয়া অঞ্চলের বড় একটি শহর কনিয়া। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকে সেলজুক রাজবংশের শাসনামলে রাজধানী শহর হিসাবে স্বীকৃতি পায় কনিয়া। সেই সময়ে স্থাপিত আলাউদ্দীন মসজিদ ও সেলজুক প্যালেস এখনো প্রশংসার দাবি রাখে। ফার্সি ধর্মতত্ত্ববিদ ও সুফি ব্যক্তিত্ব রুমির দরগা কনিয়ার একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। রুমির অনুসারীরাই মেভলেভি অর্ডারের উদ্ভাবক। যেটিকে আমরা ঘূর্ণায়মান দরবেশ হিসেবেই ভাল চিনি। এই অনুসারীরা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পা অব্দি সাদা রঙের গাউন পড়ে বাঁ পায়ে ভর করে ঘুরতে থাকে।
থাকা এবং খাওয়া
থাকা এবং খাওয়ার জন্য প্রতিটি ট্যুরিস্ট জায়গায় পর্যাপ্ত হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট আছে। আর এখানে মূলত খাবার বলতে কাবাব আইটেমটাই বেশি যা তারা রুটি দিয়ে খেয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের কাবাব আপনি চাইলেই খেতে পারেন। তাছাড়া থাকবার জন্য হোটেল পেতেও বেগ পেতে হবেনা। এখানে ভালো মানের হোটেল ও ট্রান্সপোর্টেশনের জন্য বেশ টাকাপয়সা খরচ করতে হবে আপনাকে, তাই যেসব যায়গায় মোটামুটি হাটা দুরত্বে ঘুরতে পারবেন, সেখানে গাড়ি না নেওয়াই ভালো। তবে এখানের মানুষ, আবহাওয়া, স্থাপত্য, সংস্কৃতি ও শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই আপনার ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় যোগ করবে এক নতুন মাত্রা, এটা নিশ্চিত!
উত্তম সময় যাওয়ার
তুরস্কতে যাওয়ার উত্তম সময় হল জুল থেকে অক্টোবর এ সময় আবহাওয়া বেশ অনবাংলাদেশ থেকে তুরস্কগামী বেশ কিছু ফ্লাইট আছে যার মধ্যে টার্কিশ এয়ারলাইনস অন্যতম। এছাড়া আছে এতিহাদ, এমিরেটস, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস, জেট এয়ারওয়েজ, মালিন্দ এয়ার, এয়ার ইন্ডিয়া ইত্যাদি। বিমান খরচ আপনি কবে, কখন, কোন ক্যারিয়ারে যাচ্ছেন, তার ওপর প্রধানত নির্ভর করে থাকে।
যাতায়াত
বাংলাদেশ থেকে তুরস্কগামী বেশ কিছু ফ্লাইট আছে যার মধ্যে টার্কিশ এয়ারলাইনস অন্যতম। এছাড়া আছে এতিহাদ, এমিরেটস, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস, জেট এয়ারওয়েজ, মালিন্দ এয়ার, এয়ার ইন্ডিয়া ইত্যাদি। বিমান খরচ আপনি কবে, কখন, কোন ক্যারিয়ারে যাচ্ছেন, তার ওপর প্রধানত নির্ভর করে থাকে।
Commenti