top of page

জর্ডান কথা : জেরাস




জর্ডানএর কথা শেষ হচ্ছে না । কীভাবে শেষ হবে ? সব ধর্ম , সব সভ্যতা কোথাও না কোথাও এই দেশটিকে স্পর্শ করেছে । হাজার বছরের সেই সব ইতিহাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর ভাঁজে ভাঁজে । ২/৪/১০ দিনে আপনি হয়তো একনজর কিছু স্থান দেখবেন কিন্তু তার নির্যাস থেকে যাবে আপনার ভিতরে বহুদিন । আর ইতিহাস প্রেমী হলে তো কথাই নেই , শিহরিত হবেন অনাদিকাল ।

আম্মানের ত্রিশ মাইল উত্তরে জেরাস – একটা গোটা রোমান শহর প্রায় অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এরকম উদাহরণ তামাম দুনিয়ায় আর খুব একটা পাওয়া যায়না। রোমান থিয়েটার, বিশালাকায় corinthian থামে ঘেরা গোলাকৃতি প্লাজা, বাজার-দোকান, ওমরাদের প্রাসাদ, চার্চ, ঘোড়দৌড়ের মাঠ – সব মিলিয়ে জেরাশের পাথরে মোড়ানো ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়ালে মনে হয় ইতিহাসের পাতায় চলাফেরা করছি। তবে সে ইতিহাস শুধু রোমানদের ইতিহাস নয়। জেরাস-এর (তখন নাম ছিল গেরাসা) একটি প্রস্তরফলক থেকে জানা যায় এই শহরের পত্তন করেছিলন গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার স্বয়ং, ৩৩১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। ৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জেরাসের দখল নেয় রোমানরা। রোমান সাম্রাজ্য তখন পূবদিকে বাড়তে শুরু করেছে। এই সময়েই জেরাস তার প্রতিপত্তির শিখরে পৌঁছায়। এরপর পরবর্তী প্রায় হাজার বছর ধরে জেরাসের পাথর বাঁধানো রাস্তায় হেঁটেছে রোমান, মিশরীয়, অ্যাসিরিয়ান, ব্যাবিলনিয়ান, গ্রীক, ন্যাবাটিয়ান, বাইজেন্টাইন, পার্সী, মুসলিম ইত্যাদি বিবিধ জাতির লোকেরা। ঝগড়া-কাজিয়া হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য হয়েছে। এই সহস্রাব্দের ইতিহাসের একটা গোদা বিবরণ, বা বলা ভালো ইঙ্গিত, ধরা আছে জেরাসের পাথরে।

গোটা জীবন ধরে ইতিহাস বইতে যে রোমান সাম্রাজ্যের কথা পড়ে এসেছি, তাদের হাতে বানানো স্থাপত্যকর্মের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছি, ছুঁয়ে দেখতে পারছি – এ এক গায়ে কাঁটা দেওয়া অভিজ্ঞতা।

প্রাচীন জেরাস গেরাসা নামেও পরিচিত ছিল। গেরাস ছিল মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীনতম প্রাচীনতম রোমান শহরগুলির মধ্যে একটি। তবে মাঝে মাঝে লৌহ ও ব্রোঞ্জ যুগের চিহ্নও পাওয়া গেছে। তখন অবশ্য শহরটি ছিল নগণ্য। এটি শুধুমাত্র রোমান শাসনের অধীনে এর বিশাল গর্জন অনুভব করেছিল। একটি প্রধান ব্যবসায়িক শহর হিসাবে, গেরাসা এমনকি পুরোনো শহরটিকে তৈরি করেছিল রক শহর পেট্রা শহরের প্রতিযোগী।

অনেক গৌরবের কথা বলে জেরাস যেমন মন্দির, খিলানপথ, স্তম্ভ এবং দুটি অ্যামি্পথিয়েটার. যাইহোক, 749 খ্রিস্টাব্দে একটি বড় ভূমিকম্প শহরটিকে ধ্বংস করে দেয়। তারপরে এটি ধীরে ধীরে মরুভূমির বালির নীচে অদৃশ্য হয়ে যায় । 1806 সালে এটি পুনরায় আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত এই শহর সম্পর্কে আমাদের খুব একটা জানা হয়ে উঠেনি । আশ্চর্য ভাবে বালির নীচে ভাল সংরক্ষণের কারণে, অনেকগুলি কাঠামো ব্যতিক্রমীভাবে ভালভাবে সংরক্ষিত হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এখনো সদম্ভে জেরাস তার দর্শকদের অতীতের জগতে নিয়ে যায় কোন কার্পণ্য ছাড়া।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা, ঐতিহাসিকরা সেসব ইঙ্গিত থেকে শহরটার সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করতে পেরেছেন – কোন শ্রেণির মানুষ কোথায় থাকত, তাদের জীবনযাত্রাই বা কেমন ছিল, বাজার কোথায় বসত, লোকজন বিকেলবেলা হাওয়া খেতে কোথায় যেত, আমোদ-প্রমোদের আকার-প্রকারগুলো কি রকম ছিল, তাজমহল নাকি কাবাব-বিরিয়ানি – কোনটা দেখে/ চেখে লোকে বেশি আহা-উহু করত এই স-ব কিছু। তাই সচেতন পর্যটকের কাছে আজ জেরাস আর শুধুমাত্র পরিত্যক্ত ঐতিহাসিক রোমান নগরীর সাক্ষ্যবহনকারী নয়, বরং অক্ষত এক রোমান শহর, যেখানে প্রত্যেক মুহুর্তে মনে হয় এখনই বুঝি পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে ঘোড়সওয়ার রোমান সেনার দল, বাজার থেকে ভেসে আসবে ফিরিওয়ালাদের হাঁকডাকের আওয়াজ।

জর্ডান ভ্রমনের পরিকল্পনা যারা করছেন তারা অবশ্যই এই স্থানটি রাখবেন আপনাদের তালিকায় । যারা আমার মতো ইতিহাস পছন্দ করেন , তারা সম্ভব হলে একটু বেশি সময় রাখবেন জেরাসের জন্য । এর প্রতিটি পাথর সাক্ষ্য দিচ্ছে অজানা ইতিহাসের , কিছুদূর হেঁটে একটু বসুন , বাতাসে তার গন্ধ পাবেন । এ যেন এক জ্যন্ত ইতিহাস ।

bottom of page